যেকোনো কারণে মুসলিম স্বামী বা স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে, বিবাহ বিচ্ছেদের সঙ্গে কিছু বিষয় জড়িয়ে থাকে। যেমন: দেনমোহর, ভরণপোষণ এবং সন্তানের অভিভাবকত্ব। পৃথিবীর অনেক দেশে বিবাহ বিচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়গুলোরও সমাধান হয়ে যায়। কারণ সেখানে তালাক কার্যকরের জন্য আদালতে আশ্রয় নিতে হয় এবং আদালতের আইন সেভাবেই ঢেলে সাজানো হয়। যাতে আপনি তালাক কার্যকরের পাশাপাশি সম্পত্তি এবং সন্তানের বিষয় নিষ্পত্তি করে নিতে পারেন।
আমাদের দেশে তালাকের ক্ষেত্রে দেনমোহর, ভরণপোষণ আর সন্তানের দায়িত্বের বিষয়ে পারিবারিক আদালতে আলাদা আলাদা করে মামলা করতে হয়। যা একদিকে যেমন সময় সাপেক্ষ অন্যদিকে ব্যয়বহুল। এ দেশে তালাক, দেনমোহর, ভরণপোষণ ও সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য যদি একটি আইনের আওতায় আনা হয়। আর সে আইন যদি পারিবারিক আদালতে নিষ্পত্তি করা হয়, তাহলে তালাক পরবর্তী যে সমস্যাগুলি সামনে আসে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ হয়।
আমাদের দেশে বিবাহ বিচ্ছেদ কার্যকর করতে হলে আইন অনুযায়ী কিছু পদ্ধতি মানতে হয়। বিশেষ করে তালাকের নোটিশ পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব নিয়ম যথাযথ না মানলে তালাক কার্যকরে জটিলতা সৃষ্টি হয়। তালাকের নোটিশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে যথাযথ পদ্ধতি না মানলে আইনে শাস্তির বিধানও রয়েছে। তবে স্ত্রীর ক্ষেত্রে কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে যদি তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেওয়া থাকে, সে ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি তালাক প্রদান করতে পারেন। যদি এ ক্ষমতা স্ত্রীকে দেওয়া না থাকে, তাহলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হবে।
তালাকের নোটিশ দেওয়ার পদ্ধতি
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭(১) ধারা অনুযায়ী, বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে যে পক্ষ তালাক দিতে চাইবে সে পক্ষ সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের মেয়রের কাছে নোটিশ লিখিতভাবে পাঠাবে। এ ক্ষেত্রে ওই নোটিশের কপি অপর পক্ষের কাছেও পাঠাতে হবে। তবে আদালতের মাধ্যমে কোনো তালাকের ডিক্রির কপি চেয়ারম্যানকে প্রদান করলে নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তালাকের নোটিশ উপযুক্ত সাক্ষীর উপস্থিতিতে কাজির মাধ্যমে পূরণ করে পাঠানো উচিত। এতে আইনগত জটিলতা থাকে না।
যে পক্ষ থেকেই তালাকের নোটিশ দেওয়া হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান বা মেয়র নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের মনোনীত প্রতিনিধি নিয়ে সালিসী পরিষদ গঠন করবেন। সালিসী পরিষদ উভয় পক্ষকে লিখিত নোটিশ পাঠিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করবেন। প্রথম নোটিশে কোনও পক্ষ হাজির না হলে পরবর্তী দুই মাসে আরও দুটি নোটিশ পাঠাবেন। এ ক্ষেত্রে সমঝোতার চেষ্টা সফলও হতে পারে আবার ব্যর্থও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সালিসী পরিষদের কাজ হল আপসের চেষ্টা ব্যর্থ নাকি সফল হয়েছে, তা লিপিবদ্ধ করা।
তালাকের নোটিশ না দেওয়ার সাজা
তালাকের ক্ষেত্রে আইনে প্রদত্ত নিয়ম পালন না করলে এক বছর পর্যন্ত বিনা শ্রম কারাদণ্ড কিংবা ১০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।
তালাকের কার্যকারিতা
চেয়ারম্যান বা মেয়রের কাছে যে তারিখে নোটিশ পৌঁছাবে, সে দিন থেকে ৯০ দিন পর বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাক কার্যকর হবে। এ নোটিশ পাওয়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করতে হবে এবং সমঝোতার উদ্যোগ নিতে হবে। নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে সালিশের উদ্যোগ নেওয়া না হলে তালাক কার্যকর বলে গণ্য হবে। তবে স্ত্রী গর্ভবতী থাকলে গর্ভকাল শেষ হওয়ার পর তালাক কার্যকর হবে।
তালাক নিবন্ধন
যে পক্ষই তালাক প্রদান করুক না কেন, তালাক কার্যকরের পর তালাকটি যে কাজির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়েছে, সে কাজি অফিসে নিবন্ধন করাতে হবে। তালাক নিবন্ধন করা আইনত বাধ্যতামূলক। কোনো কারণে তালাক নিবন্ধন অস্বীকার করলে ৩০ দিনের মধ্যে রেজিস্টারের কাছে আপিল করার বিধান আছে।
ঠিক কোন কারণে স্ত্রী বিচ্ছেদ চাইছেন। স্বামীর বদভ্যাস, বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা শারীরিকভাবে অক্ষম কিংবা মনের অমিল। যে কারণেই হোক না কেন। স্ত্রী চাইছেন স্বামীর সংসার আর করবেন না। আর স্বামীকে এ কথা জানিয়ে দিলেন। কিন্তু স্বামী স্ত্রীকে ছাড়তে নারাজ। স্ত্রী এর আগে অনেকবার স্বামীকে শোধরানোর সুযোগ দেন। কিন্তু স্বামী কিছুদিন পর আগের মতন ব্যবহার করেন। সে ক্ষেত্রে দেয়ালে একেবারে পিঠ ঠেকে গেলে স্ত্রীর ক্ষেত্রে বিচ্ছেদই শেষ সিদ্ধান্ত হতে পারে।
স্ত্রীর বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার আছে। তাঁকে জোর করে সংসার করানোর চেষ্টা কতটা যুক্তিসংগত হবে, তা স্বামীর ভেবে দেখা উচিত। যদি সংসারে সন্তান থাকে তাহলে সন্তানের কথা দুজনের ভাবা উচিত। স্ত্রী যদি বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন, তবে এ নিয়ে আর জটিলতা না বাড়ানো ভালো। তবে বিচ্ছেদ কী উপায়ে চাচ্ছেন, এটি স্ত্রীর কাছে জেনে নিতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে স্বামীকে অবশ্যই দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে। তবে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দেনমোহর-সংক্রান্ত যেকোনো সিদ্ধান্ত উভয়ে নিতে পারেন। বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্ত্রীর তাঁর কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামটিতে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কি না, তা দেখে স্ত্রী সরাসরি তালাক দিতে পারেন। যদি ১৮ নম্বর কলামে কোনো ক্ষমতা না দেওয়া থাকে, তাহলে স্বামীর উচিত হবে না এ নিয়ে স্ত্রীকে কোনো ধরনের জটিলতায় ফেলা। তখন দুজনের সম্মতিতে স্বামীই তালাক হতে পারে।
সাধারণ নিয়ম হচ্ছে স্ত্রীর তালাকের ক্ষমতা না থাকলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নেওয়া। এটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং কিছুটা জটিলও বটে। তবে মুসলিম আইনে খোলা তালাক নামে একটি পদ্ধতি আছে। যা দুজনের সম্মতিতে হয়ে থাকে। এ তালাক দুজনের চুক্তি দ্বারা, কাজি বা আদালতের নির্দেশে হতে পারে। এ তালাকের উল্লেখযোগ্য দিক হল, স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। স্বামী ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে থাকেন। এ ধরনের তালাকের ক্ষেত্রে অনেক সময় স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সময় স্বামী বিনিময়ে স্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিদান নিয়ে থাকেন এবং স্ত্রী তা দিয়ে থাকেন বা দিতে সম্মত হন।
অনেক সময় স্ত্রী যদি রাজি থাকেন, তাহলে মোহরানা দিতে হয় না। তবে বিচ্ছেদের দিন থেকে তিন মাস পর্যন্ত স্ত্রী তাঁর গর্ভস্থ সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। স্ত্রী বিচ্ছেদ চাইলে শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা উচিত। অনেক সময় দেখা যায় স্বামী তালাক চাইলেও স্ত্রীকে আগে তালাকের নোটিশ পাঠাতে বলেন। আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা আগে তালাকের নোটিশ পাঠান, তাহলে স্বামীকে দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্ত্রী আগে তালাক দিলেও তাঁর মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। এ ছাড়া যদি স্ত্রীকে আগে ভরণপোষণ না দেওয়া হয়। তাহলে এ বকেয়া ভরণপোষণ প্রদান করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ সংক্রান্ত কোনো দাবিদাওয়া থাকলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতেও যেতে পারেন। তবে স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকর হয় না।
লেখক: ব্যারিস্টার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।