পুরো সপ্তাহ শহরের কোলাহলে বাসা-অফিস ছোটাছুটি, একটুকু স্বস্তির বালাই নেই। প্রাণের শহরের মানুষের অবসরটাও যেন কাটে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে। তাই ছুটির দিনে একটু সময় করে পরিবার বা বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন ঢাকার অদূরে টাঙ্গাইলের মহেড়া জমিদার বাড়িতে। এমনি এক ছুটির দিনে বেড়াতে গিয়েছিলাম টাঙ্গাইল সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে মহেড়া জমিদার বাড়িতে। ঢাকার মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে আমরা সকাল সাড়ে ৭টায় নিরালা বাসে রওনা হই। বাস আমাদের নামিয়ে দেয় টাঙ্গাইলের নটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে অটোরিকশা চেপে পৌঁছে যাই গন্তব্যে। প্রায় আট একর জায়গা জুড়ে মহেড়া জমিদার বাড়ির বিস্তৃতি। জনপ্রতি টিকিট মূল্য ৮০ টাকা। আমরা বিশেষ আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম বলে টিকিট ছাড়াই প্রবেশ করলাম। জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশ পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকায় পরিবেশটা বেশ পরিপাটি।
জমিদার বাড়িতে প্রবেশের আগেই চোখে পড়ে বিশাখা সাগর নামে একটি দীঘি। সুপ্রশস্ত দুই সদর দরজা পাড় হয়ে প্রবেশের পর দেখা যায়, নিজ ঐতিহ্যের নিদর্শন স্বরূপ সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রধান দালানটি। সুবিশাল চারটি ঐতিহাসিক লজ, চৌধুরী লজ, মহারাজ লজ, আনন্দ লজ, কালীচরণ লজ। এছাড়াও জমিদার বাড়িতে রয়েছে নায়েব সাহেবের ঘর, কাচারি ঘর ও বাবুর্চিদের ঘর। জমিদার বাড়ির সাথেই রয়েছে ছোট পার্ক, ছোট গোছানো একটা চিড়িয়াখানা, পিকনিক স্পট ও বোট রাইডের ব্যবস্থা। মূল ভবনে পেছনের দিকে রয়েছে দুটি পুকুর। একটির নাম পাসরা পুকুর, অন্যটি রানি পুকুর।
মহেরা জমিদার প্রধান বাড়ির প্রধান আকর্ষণ লজগুলো
সদর দরজা দিয়ে জমিদার বাড়িতে প্রবেশের পরই দেখা যায় চৌধুরী লজ। ভবনটির পিলারগুলো দেখলে বোঝা যায়, সেগুলো নির্মাণে রয়েছে রোমান স্থাপত্য শৈলীর ছোঁয়া। দোতলা এই ভবনের সামনে রয়েছে সুন্দর বাগান ও সবুজ মাঠ।
ঝুলন্ত বারান্দার বাঁকানো রেলিং একদমই অন্যরকমভাবে শোভা বাড়িয়েছে বাইজেনটাইন স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত মহারাজ লজের। ভবনের সামনে ছয়টি কলাম, আর কক্ষ আছে ১২টি। তার মধ্যে নিচতলার একটি কক্ষে ছিল আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আমরা পৌঁছে ব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র সেখানে রেখে চলে যাই ওপরে খাবার ঘরে।
জমিদার বাড়িটির সব লজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে আনন্দ লজ। নীল-সাদা রঙের ভবনটির সামনে আটটি সুস্পষ্ট কলাম রয়েছে। তিন তলার ঝুলন্ত বারান্দা ভবনটিকে করেছে আরও দৃষ্টিনন্দন।
জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির একদম শেষের দিকে নির্মিত কালীচরণ লজ অন্যগুলো থেকে অনেকটাই আলাদা। ইংরেজ স্থাপত্য শৈলীতে ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের আদলে নির্মিত এই ভবনটি।
ইতিহাস বলছে, বংশীয়ভাবে বনেদি ব্যবসায়ী ছিলেন মহেরার সাহা বংশের জমিদাররা। স্পেনের কর্ডোভা নগরীর আদলে জমিদার বাড়িটি ১৮৯০ দশকের আগে নির্মাণ করা হয়ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা জমিদার বাড়িতে হামলা করে। এ সময় বাড়ির ভেতরে তারা পাঁচজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। পরবর্তীতে লৌহজং নদীর নৌপথ দিয়ে তারা এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন এখানে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। পরে ১৯৭২ সালে জমিদার বাড়িটি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৯৯০ সালে ট্রেনিং স্কুলটি পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে পরিণত করা হয়।
টিকিট
মহেড়া জমিদার বাড়িতে প্রবেশের টিকিট ৮০ টাকা করে। সঙ্গে গাড়ি থাকলে পার্কিং ফি ৫০ টাকা। ছোট পার্কে প্রবেশ করতে টিকিট মূল্য ২০ টাকা। আর সুইমিংপুলে সাঁতার কাটতে চাইলে দিতে হবে ৩০০ টাকা। আর বোট রাইডে চড়তে করতে হবে দরদাম।
ঢাকা থেকে কিভাবে যাবেন
মহেড়া জমিদার বাড়ি দেখতে প্রথমে যেতে হবে টাঙ্গাইল জেলার নটিয়াপাড়া বাসস্ট্যান্ড। মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। যেতে সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এ বাসগুলোতে টাঙ্গাইল যেতে ভাড়া লাগে ১৪০ থেকে ২০০ টাকা। নটিয়াপাড়ায় বাস থেকে নেমে অটোরিকশা যোগে মহেরাপাড়া পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আসতে হবে। বর্তমানে মহেরা জমিদার বাড়িটি পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ট্রেনে যেতে চাইলে উত্তরবঙ্গগামী যে ট্রেন মহেরা স্টেশনে স্টপেজ দেয় সেটির খোঁজ নিয়ে দেখা যেতে পারে।
থাকার ব্যবস্থা
জমিদার বাড়িতে পরিবারের সদস্য বা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দিনে দিনে ঘুরে চলে আসতে পারেন। তবে যদি থাকতে চান সেই ব্যাবস্থাও আছে সেখানে। সেক্ষত্রে প্রতি রাতে গুনতে হতে হবে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
কোথায় খাবেন
মহেরা জমিদার বাড়িতে স্বল্প মূল্যের একটি ক্যান্টিন রয়েছে। আগে অর্ডার দিলে এখানে পছন্দের খাবার পাওয়া যায়।