বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে নবীজির যুগে – News Portal 24
ঢাকাThursday , ২৬ মে ২০২২

বাংলাদেশে ইসলাম এসেছে নবীজির যুগে

নিউজ পোর্টাল ২৪
মে ২৬, ২০২২ ১২:০২ অপরাহ্ন
Link Copied!

বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম ইসলাম এবং মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই অবস্থা হঠাৎ করে হয়নি, বরং রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগ থেকেই এ দেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয়ে যায়। উইকিপিডিয়ার তথ্যে বলা হয়, নবীজি (স.)-এর জন্মগ্রহণের ৫০ বছর পর ৬২০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইসলাম আসে।

ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত কথা হলো, আরব বণিকদের মাধ্যমেই এদেশে ইসলাম এসেছে। আরব থেকে আগত মুসলমান বা স্থানীয় মুসলমান- যারা ৬৯ হিজরিতে এ এলাকায় বসবাস করেছিলেন তারাই নিজেদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। সেই থেকে বা তারও আগে থেকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়।

‘জাতীয় অধ্যাপক’ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে, হজরত ওমরের (রা.) শাসনামলে মামুন, মুহাইমেন (রা.) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেন। ইসলাম প্রচারের এ ধারা আব্বাসী খেলাফতকালে আরও জোরদার হয়। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার খননকালে দুটি আরবি মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রা দুটি তৈরি হয়েছিল ৭৮৮ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশিদের আমলে।

ইতিহাসবিদ ড.এনামুল হকের মতে, কোনো ইসলাম প্রচারক এই মুদ্রাগুলো বহন করেছিলেন। পাহাড়পুরে আসার পর বৌদ্ধদের হাতে তিনি শহীদ হন।

কুমিল্লা জেলার ময়নামতিতে খননকালে আব্বাসী যুগের আরও দুটি স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়। এসব মুদ্রা এ কথাই প্রমাণ করে, খৃস্টীয় অষ্টম-নবম শতকে এদেশে আরব মুসলমানদের মাধ্যমে ইসলামের চর্চা ও প্রচারের কাজ চালু ছিল।

ইসলাম প্রচারকদের আগমনের সুনির্দিষ্ট সময় নিয়ে ইতিহাসবিদদের নানা কথা থাকলেও বিশুদ্ধ মত হলো মহানবী (স.) জীবিত থাকা অবস্থায়ই এদেশে ইসলামের দাওয়াত এসে পৌঁছায়। নবীজির (স.) নবুওয়তের সপ্তমবর্ষে ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি হজরত আবু ওয়াক্কাস মালিক বিন ওহাইবের (রা.) চীনে আগমনই এ কথার পক্ষে জোরালো প্রমাণ বহন করে। তখন তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন আরও তিন সাহাবি। তাঁরা হলেন হজরত কাসেম ইবনে হুজাইফা (রা.), উরওয়া ইবনে আসাসা (রা.) এবং আবু কায়েস ইবনুল হারিসও (রা.)। চীনে যাবার পথে তারা বাংলাদেশের বন্দর বিশেষত চট্টগ্রাম ও সিলেটে নোঙ্গর করেছেন এবং তাদের সান্নিধ্যে এদেশের কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন।

রংপুর জেলার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রাসুলুল্লাহ (স.)-এর মামা, মা আমেনার চাচাতো ভাই আবু ওয়াক্কাস (রা.) ৬২০ থেকে ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন (পৃ. ১২৬)। অনেকে অনুমান করেন, পঞ্চগ্রামের মসজিদটিও তিনি নির্মাণ করেন যা ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে সংস্কার করা হয়। মতিউর রহমান বসুনিয়া রচিত ‘রংপুরে দীনি দাওয়াত’ গ্রন্থেও এই মসজিদের বিশদ বিবরণ আছে।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্তের নিরিখে উইকিপিডিয়ায় বলা হয়, ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দে দেশের প্রথম মসজিদ নির্মিত হয় লালমনিরহাট জেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের ‘মজেদের আড়া’ নামক গ্রামে। এটির নাম সাহাবায়ে কেরাম জামে মসজিদ। ১৯৮৭ সালে পঞ্চগ্রামে জঙ্গল খননের সময় প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। এর একটি ইটে কালেমা তাইয়্যেবা ও ৬৯ হিজরি লেখা রয়েছে।

খননের পর মসজিদের মেহরাব এবং মসজিদ সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠ ও খুতবার মিম্বরও আবিষ্কৃত হয়। এলাকার লোকজন এ মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ। এ থেকে অনুমান করা হয়, মসজিদটি হিজরি ৬৯ অর্থাৎ ৬৯০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে স্থাপন কিংবা সংস্কার করা হয়।

‘এসব তথ্য প্রমাণ করে যে, দেশে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন খিলজী নয়, বরং ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে তার বাংলা বিজয়ের প্রায় ৬০০ বছর আগেই সাহাবিদের দ্বারা বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়। প্রথম মসজিদও নির্মিত হয় সেই সময়েই।

ঐতিহাসিকদের মতে, প্রাক ইসলামি যুগে আরব বণিকরা সমুদ্র পথে আবিসিনিয়া ও চীন পর্যন্ত তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেন। আরব-চীনের মধ্যে তাদের কয়েকটি ঘাঁটিও ছিলো। এ পথে তাদের প্রথম ঘাঁটি ছিলো মালাবর। তারা নিয়মিত মালাবরের উপর দিয়ে চট্টগ্রাম, সিলেট ও কামরূপ হয়ে চীনে আসা যাওয়া করতেন। এভাবেই চট্টগ্রাম ও সিলেট তাদের যাতায়াতের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হত।

মূলত এ সূত্র ধরেই নাম নাজানা আরো বহু সাহাবী দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলোতে ইসলাম প্রচারে কাজ করেছেন। চীনের ক্যন্টনসমুদ্র তীরবর্তী হজরত আবু ওয়াক্কাসের (রা.) মাজার আজও সেই সাক্ষ্য বহন করে আছে। সমুদ্র তীরের কোয়াংটা মসজিদও তিনিই নির্মাণ করেন বলে ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত।

ড. মোহাম্মদ হাননান। বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকজন শ্রেষ্ঠ গবেষকের একজন। বাংলাদেশে যাঁরা ইসলাম নিয়ে গবেষণা করেন ও লেখালেখি করেন, ড. হাননানের স্থান সবার ওপরে। তাঁর লিখিত তিন খণ্ডের ‘প্রাচীন বাংলায় মুসলিম আগমন’ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, বাংলাদেশে রাসুলুল্লাহ (স.)-এর যুগেই ইসলাম প্রচার হয়েছে। এ বইয়ে তিনি সেসব সাহাবির তালিকাও দিয়েছেন, যাঁরা বাংলাদেশে এসেছেন। প্রাচীন আমলে আরব বণিকদের কর্মকাণ্ড, তাঁদের কবর, তাঁদের পরিণতি ইত্যাদি বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন।

ড. আহমদ শরীফ বাংলা ভাষায় মুসলিম সাহিত্য রচনার প্রাচীন উপাদানের অন্যতম আবিষ্কারক ও গবেষক। বাংলায় মুসলিমদের আগমন সম্পর্কে তাঁর ধারণাটি দেখুন—

মদিনা থেকে মুলতান অবধি ইসলামের প্রসার বলতে গেলে প্রায় অবাধেই ঘটেছিল। …তুর্কি বিজয়ের আগেই এখানে আরব-ইরানি বেনেদের সঙ্গে দরবেশ-প্রচারকদের আগমন শুরু। …অন্তত আট শতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়। …Periplus in the Erytheon -এর আলোকে যাচাই করলে এ সম্পর্ক খ্রিষ্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব। চট্টগ্রাম বন্দরে আরব বেনেরা বছরে কয়েক মাস থেকে যেত। …আমাদের মনে হয় তখনো মুসলিম সমাজে সুফি মতবাদ প্রসার লাভ করেনি…। (আহমদ শরীফ : বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা ১৯৭৮, পৃষ্ঠা-১০২-১০৩)

ড. আহমদ শরীফের এই ধারণায় বেশ কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রথমত যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হলো, ‘তুর্কি বিজয়ের আগেই এখানে (মানে বাংলাদেশে লেখক) আরব-ইরানি বেনেদের সঙ্গে দরবেশ-প্রচারকদের আগমন শুরু। ’ এ মন্তব্য থেকে ইবনে বখতিয়ার খিলজির আগমনের মাধ্যমেই ১২০৪ সাল থেকে বাংলায় মুসলিমদের প্রথম আগমনের এতকালের মিথটি বাতিল হয়ে যায়।

একই সঙ্গে মুসলিম প্রবেশের কাল গণনাটিও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও তিনি বলেছেন, ‘অন্তত আট শতক থেকে আরবদের সঙ্গে বাঙলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়’, তথাপি তাঁর এই অনুমানও যথার্থ যে গ্রিক সাহিত্যের দলিল অনুযায়ী ‘এ সম্পর্ক খ্রিস্টীয় প্রথম শতক অবধি পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব।’  এ দালিলিক ধারণা থেকে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব যে মুহাম্মদ (স.)-এর জীবদ্দশাতেই অথবা ওফাতের পরপরই (৬৩২ খ্রিস্টাব্দের আগে-পরে) বাংলাদেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আরব মুসলিমরা প্রবেশ করেছিলেন।