সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মেজর সিনহা মো: রাশেদ খান হত্যা মামলার আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ডাদেশ শোনার পরই একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন ভুক্তভোগীরা।
‘আঙ্কেল আমার বাবাকে হত্যা করে তিন বোনকে এতিম করে দিয়েছে ওসি প্রদীপ। এখন আমাদের পড়াশোনা বন্ধ। অভাবের কারণে ঠিকমতো খেতে পারি না। থাকি অন্যের বাসায়। আমি বাবা হত্যার বিচার চাই। প্রদীপের ফাঁসি চাই।’
সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার রায়ে ৩১ জানুয়ারি টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের মৃত্যুদণ্ডাদেশের পর প্রক্রিয়া জানতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে এক কথা বলে ৭ বছর বয়সি সাকিয়া আক্তার। সে টেকনাফে নাজির পাড়ায় পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত দিনমজুর কৃষক নুর মোহাম্মদের মেয়ে। তার আরও দুই বোন রয়েছে। নাম সাদিয়া আক্তার (১০) ও মাহিয়া আক্তার (৫)।
কৃষক নুর মোহাম্মদের স্ত্রী (সাকিয়ার মা) লায়লা বেগম বলেন, ‘টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ আমার স্বামীকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে ৪৫ লাখ পরে ২৫ লাখ টাকা দাবি করে। ধারদেনা করে তিন লাখ টাকা দিলেও আমার স্বামীকে হত্যা করে সে। এখন সন্তানদের নিয়ে বড় কষ্টে আছি। এতিম তিন শিশুকে তিনি ঠিকমতো খাওয়াতে পারছি না। মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজন সহায়তায় দিলেও তিন কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’
সাকিয়াদের মতো কথিত বন্দুকযুদ্ধে বাবা হারিয়েছেন একই এলাকার অবুঝ শিশু মুস্তাকিম (৪)। সে ভালোভাবে কথা বলতে না জানলেও কেউ বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেন, ‘প্রদীপ আমার বাবাকে গুলি মেরেছে। আমি আল্লাহকে বিচার দিয়েছি।’
মুস্তাকিমের মা রাজিয়া বলেন, তৎকালীন ওসি প্রদীপ মানুষের ঘর ভাঙচুর করার সময় সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিল আমার স্বামী কামাল। এ কারণে তাকে ধরে নিয়ে ক্রসফায়ার হত্যা করে প্রদীপ। অভাবের কারণে ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আমি উদ্বিগ্ন।
টেকনাফ হৃীলা ইউনিয়নের রঙ্গিখালী গ্রামের শাহ আলম জানায়, তার দুই ভাইকে একসঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ। একইভাবে ২০১৯ সালের ২১ জুলাই টেকনাফ হোয়াইক্যং সাতঘরিয়াপাড়ায় ওসি প্রদীপের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন হতদরিদ্র মো. হোসেন ও মোহাম্মদ কাশেম। তারা আপন দুই ভাই। দুই ভাইয়ের ৯ ছেলেমেয়ে রয়েছে। স্থানীয়রা জানান, এখন ভিক্ষাবৃত্তি ও স্থানীয়দের সহায়তায় চলছে তাদের জীবন।
স্থানীয়রা জানান, পূর্বশত্রুতার জেরে স্থানীয় এক ব্যক্তি কোটি টাকার বিনিময়ে ওসি প্রদীপকে ভাড়া করে হতদরিদ্র দুই ভাইকে হত্যা করে ইয়াবা কারবারি হিসাবে প্রচার করে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যানের শাহাজান মিয়া জানান, তার ইউনিয়নে প্রদীপ আমলে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আনুমানিক ২০ থেকে ২৫ জন নিহত হয়েছেন। তারা অন্তত অর্ধশতাধিক শিশু সন্তান রেখে গেছেন। অভাবের কারণে অনেকের পরিবার ভিক্ষাবৃত্তি করে চলছে বলে শুনতে পেয়েছি। তিনি আরও জানান, বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের তালিকা অনুযায়ী খোঁজ নিলে টেকনাফ উপজেলায় তিনশর বেশি এতিম শিশু পাওয়া যাবে।
টেকনাফ হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, ‘ওসি প্রদীপ আমলে জানামতে আমার ইউনিয়নে বন্দুকযুদ্ধে ২১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের অন্ততপক্ষে ৭০ জন শিশু ছেলেমেয়ে রয়েছে। বেশিরভাগ পরিবারই আর্থিকভাবে কষ্টে রয়েছে বলে শুনতেছি। এমনকি অনেক শিশু লেখাপড়া বাদ দিয়ে শিশুশ্রমে জড়িয়েছে। কেউবা পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছে।’
মানবাধিকার কর্মী ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা জাহেদ হোসেন বলেন, টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধের নিহতদের মধ্যে আনুমানিক ২০ থেকে ২৫টি পরিবার মোটামুটি আর্থিকভাবে সচ্ছল। বাকি ১৮০টি পরিবার হতদরিদ্র। এসব পরিবারের ভার কেউ গ্রহণ না করলে শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢেকে যাবে।