ভূমধ্যসাগরেই শেষ ইতালির যাওয়ার স্বপ্ন, টাকা গেল ছেলেও গেল! – News Portal 24
ঢাকাSunday , ৩০ জানুয়ারী ২০২২

ভূমধ্যসাগরেই শেষ ইতালির যাওয়ার স্বপ্ন, টাকা গেল ছেলেও গেল!

নিউজ পোর্টাল ২৪
জানুয়ারী ৩০, ২০২২ ৯:৪৫ অপরাহ্ন
Link Copied!

ভূমধ্যসাগরে কিছুতেই থামছে না মৃত্যুর মিছিল। লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠান্ডায় প্রাণ হারিয়েছেন সাত বাংলাদেশি। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুরে।

এর আগেও মাদারীপুরের কমপক্ষে শতাধিক যুবক নিহত ও নিখোঁজ হন। বাংলাদেশ দূতাবাস ২৫ জানুয়ারি বিষয়টি জানতে পারে। ২৯ জানুয়ারি নিহত ৭ জনের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করেছে ইতালি দূতাবাস। নিহতদের পরিবারকে নিকটস্থ জেলা প্রশাসক বা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে রোম দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।

ইতালির বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ, মিসরসহ বিভিন্ন দেশের ২৮০ জনের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকায় করে লিবিয়ার উপকূল থেকে ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের উদ্দেশে রওনা করেন। যাত্রা শুরুর একদিন পর ভূমধ্যসাগরে প্রচণ্ড ঝড় বাতাসের পর টানা বৃষ্টি হয়। নৌকাটি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপের কাছাকাছি পৌঁছায়। পরে ইতালিয়ান কোস্টগার্ডের সদস্যরা তাদের উদ্ধার করেন। এ সময় প্রচন্ড ঠান্ডায় মারা যান ৭ জন। তাদের ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুর।

নিহতরা হলেন- মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামের শাজাহান হাওলাদারের ছেলে ইমরান হোসেন, বড়াইবাড়ি গ্রামের প্রেমানন্দ তালুকদারের ছেলে রতন তালুকদার জয়, ঘটকচরের সাফায়েত, মোস্তফাপুরের জহিরুল ইসলাম এবং মাদারীপুর সদরের বাপ্পী। নিহতের খবরে এসব পরিবারে চলছে শোকের মাতম।

সরেজমিনে মাদারীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম পেয়ারপুর গ্রামের নিহত ইমরানের বাড়ি দেখা জানা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে ধারদেনা করে দালাল সামাদের কাছে প্রথম কিস্তিতে ৪ লাখ টাকা দেন। পরে লিবিয়া পৌঁছানোর পরে আরো সাড়ে তিন লাখ টাকা দেন দালালের কাছে। মৃত ইমরানের বাবা ভ্যানচালক। বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে সুদ এবং এনজিও থেকে ঋণ করে ছেলেকে ইউরোপ পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে প্রচণ্ড ঠান্ডায় মারা যান ইমরান।

রতন তালুকদার জয়। তার চার চাচাতো ভাই। তাদের স্বপ্ন ছিল বিদেশ গিয়ে চাকরি করে সংসারে সচ্ছলতা আনবেন। সেই উদ্দেশ্যে দালালের মাধ্যমে তারা ইউরোপে যাচ্ছিলেন। নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেন। ওই চারজনের মধ্যে জয় মারা যান। জয়ের মৃত্যুর খবরে মাদারীপুরে তার বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নিহত জয় তালুকদারের বাড়ি সদর উপজেলার পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইলবাড়ি গ্রামে। তার বাবা পলাশ তালুকদার জয়ের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  প্রবাসী কামালপুর ইউনিয়ন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীকে অটোরিক্সা বিতরণ

নিহত জয়ের পরিবারের সদস্যরা বলেন, দালালের প্রলোভনে পড়ে গত ২৮ নভেম্বর পেয়ারপুর ইউনিয়নের বড়াইবাড়ি থেকে জয় তালুকদার ও তার চাচাতো ভাই প্রদীপ তালুকদার, মিঠু তালুকদার, তন্ময় তালুকদারসহ ছয় তরুণ ইতালিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে মাদারীপুর ছাড়েন। তারা দুবাই হয়ে লিবিয়ায় পৌঁছান। পরে লিবিয়ার একটি বন্দিশালায় প্রায় দেড় মাস বন্দি থাকেন। গত ২২ জানুয়ারি তাদের সাগরপথে যাত্রা শুরু হয়। গন্তব্য ছিল ইতালি। ওই রাতে নৌকা থেকে সাত বাংলাদেশির লাশ উদ্ধার করা হয়, যার মধ্যে মাদারীপুরের জয়ও ছিলেন।

বড়াইল বাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, জয়ের বাড়িতে গভীর নীরবতা। ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে আহাজারি করছেন মা লক্ষ্মী তালুকদার। ছেলের মুখ দেখার জন্য সবার কাছে আকুতি জানাচ্ছেন। সাগরপথে যাত্রা হওয়ার আগে ২২ জানুয়ারি সকালে জয়ের সঙ্গে তার মায়ের মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে সবশেষ বলা কথা স্মরণ করে কেঁদে উঠছেন তিনি। বলছেন, ‘আমার বাজানে মরে নাই। ও কইছে, ইতালি গিয়া ফোন দিবো। ওরে একবার ফোন দিতে কও। আমি বাজানের মুখটা একটু দেখতে চাই। জয়ের মায়ের কান্নায় চারপাশের প্রকৃতিও শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে।

নিহত জয়ের বাবা পলাশ তালুকদার পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রি। দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জয় মেজ। দালালের মাধ্যমে বিদেশ যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, আমরা গরিব মানুষ। যে কাজ করি, তা দিয়া সংসার চলানো খুবই কষ্ট। আমাদের এলাকার ছেলে জামাল। জামালই ইতালিতে নেয়ার প্রস্তাব দেন। পরে তাকে বিশ্বাস করে ধারদেনা আর জমি বিক্রি করে সাত লাখ টাকা জোগাড় করি। প্রথমে দালালকে ৫০ হাজার দিয়েছিলাম। পরে লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর সাড়ে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলাম। এতোগুলা টাকা গেল, তবু যদি ছেলেটা বেঁচে থাকতো তাহলে দুঃখ হতো না। অবশেষে কিছুই পেলাম না, ছেলে গেল টাকাও গেল।

আরও পড়ুনঃ  রাস্তায় স্ত্রীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটি, বাড়ি ফিরে স্বামীর আত্মহত্যা

জয়ের কাকা গোবিন্দ তালুকদার বলেন, আমার ছেলে প্রদীপ, ভাতিজা জয়সহ আমাদের বাড়ির চার ছেলে এই পথে ইতালিতে যায়। তারা তিনজন কোনোমতে কষ্টে ইতালিতে পৌঁছালেও জয় পথেই মারা যায়। আমরা ছেলে প্রদীপ জয়ের মৃত্যুর সংবাদ আমাদের জানিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জামাল খান বড়াইলবাড়ি এলাকার সোনা মিয়া খানের ছেলে। ইতালিতে যাওয়ার আশ্বাস দিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে জামাল সাত লাখ টাকা করে নেন। জয়ের মৃত্যুর খবরের পর থেকে তিনি এলাকায় নেই। দীর্ঘদিন ধরে জামাল মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মাদারীপুর সদর থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা রয়েছে। এই মামলায় তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। প্রায় এক বছর আগে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে বের হন। আবার শুরু করেন দালালি পেশা।

পেয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান লাভলু তালুকদার বলেন, আমার এলাকায় কিছু দালাল আছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলাও আছে। বিচার না হওয়ায় দালাল চক্র ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে কিছু টাকা আর ভয়ভীতি দেখিয়ে দালালরা মীমাংসা করে নেন। এ কারণে অবৈধপথে বিদেশযাত্রা কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।

মাদারীপুর সদর মডেল থানার ওসি কামরুল ইসলাম মিঞা বলেন, ঠান্ডার কারণে ভূমধ্যসাগরে মৃত সাত বাংলাদেশির মধ্যে ৫ জনের বাড়ি মাদারীপুর সদরে। তার পরিবারকে থানায় দালালদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে বলা হয়েছে। অভিযোগ পেলে দালালের বিরুদ্ধে মামলা নেয়া হবে।

মাদারীপুরর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুদ্দিন গিয়াস বলেন, দূতাবাস থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। মৃতদের পরিবারের পক্ষ থেকে তাদের পরিচয় শনাক্ত করণের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে। সে মোতাবেক আমরা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিলে মরদেহ দেশে আনার সব ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করবে।