ঢাকাFriday , ২ জুলাই ২০২১

হাজার-হাজার তরুণরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে কেন : রহমান মৃধা

নিউজ পোর্টাল ২৪
জুলাই ২, ২০২১ ৪:১৫ পূর্বাহ্ন
Link Copied!

মতামত:: ছোটবেলায় মার সঙ্গে বেশ সময় কেটেছে আমার। মা বিভিন্ন বিষয়ে বেশ তথ্যমূলক গল্প বলতেন। তখন তো আর ফেসবুক ছিল না যে সারাদিন সেখানে সময় পার করব।মা বই পড়তেন খুব , যার ফলে গল্পের ছলে বেশ সুন্দর করে অনেক ঘটনা বলতেন। মা নড়াইল জেলার মেয়ে।

একবার তার গ্রামের এক ব্যক্তির তিনটি মেয়ে ছিল। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। দুই মেয়ের বিয়ে হয় খুব বড়লোকের পরিবারে, তবে একটির বিয়ে হয় দরিদ্র পরিবারে। বাংলাদেশে আর যাই হোক জামাইদের কিন্তু বেশ যত্ন করা হয় , তারা যখন শ্বশুর বাড়ি আসে।

সেদিন বড়লোক দুই জামাই এসেছে, চাচার বাড়িতে রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে।বিশাল পার্টি, দুই জামাই মনের আনন্দে খাওয়া-দাওয়া করছে। সন্ধ্যায় তিন নম্বর গরিব জামাই এসেছে। তার সঙ্গে কেউ তেমন মিশছে না, বেচারা একা একা বসে আছে। রাতে তাকে আলাদা খাবার দিয়েছে, অন্যদিকে রুই-কাতলা, মুরগী আরো কত কী রান্না করা হয়েছে বাকি দুই জামাই-এর জন্য,।

‘গরিব জামাই’ -এর ভাগ্যে শুধু ডাল-ভাত জুটেছে। খাবার দেখে গরিব জামাই বলছে ‘ধনীতে ধনীতে উলামেলা, রুই কাতলে করছে খেলা, ওরে ডাল আমি এলাম হেঁটে,তুই এলি কিসে?’ দুঃখের বিষয় গরিব জামাই বাবু সেদিন বাড়ি থেকে ডাল-ভাত খেয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছিলেন।

বহু বছর আগের গল্পটা মনে পড়ে গেল, গত কয়েকদিন আগের একটি নিউজ দেখে । বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু লোক ভাগ্যের উপর জীবন বাজি রেখে (প্রায় ৩০০) দালালের মাধ্যমে সাগরের পরে মহাসাগর পাড়ি দিয়েছে, ইউরোপে বসবাস করার স্বপ্নে। ভূমধ্যসাগরে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড একটি কাঠের নৌকা থেকে বাংলাদেশিদের উদ্ধার করে।

তাদের সাময়িক ঠাঁই হয়েছে তিউনিসিয়ার জার্জিস শহরে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আশ্রয়কেন্দ্রে। উদ্ধার হওয়া তরুণদের অনেকেই লিবিয়া হয়ে ইতালি আসার চেষ্টায়, পথে ধরা পড়েছে । এর কিছুদিন আগেও কিছু বাংলাদেশি সমুদ্রে তলিয়ে গেছে।এবার অনেকেই কোনোরকমে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছে। তবু কেউ দেশে ফিরতে চান না ।

কেননা , ইতালি যাওয়ার টাকা জোগাড় করতে অনেক ঋণ করেছেন। দেশে ফিরলে ঋণ শোধ করতে পারবেন না। তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ২২ দিনে প্রায় ৫০০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাংলাদেশ থেকে গেছেন ‘২ হাজারের বেশি বাংলাদেশি!’

প্রতিনিয়ত সতর্কবাণী সত্ত্বেও হাজার হাজার তরুণ বিদেশে চাকরির জন্য গিয়ে সমুদ্রে ডুবে যান, মরুভূমি ও গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যান, এর পেছনে আছে অসহনীয় বেকারত্ব। দেশের ভেতরে ন্যূনতম কিছু করার থাকলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে যেতেন না।

সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চাকরি না করে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন।

কিন্তু কিছু করার উদ্যোগ নেয়ার পরিবেশ দেশে কতটা আছে ?বিদেশে চাকরির বাজার সংকুচিত। দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হতে পারেনি করোনার কারণে । ফলে তারা দেড়-দুই বছর পিছিয়ে গেছে। শিগগিরই করোনা পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষণ দেখাও যাচ্ছে না ।

এ অবস্থায় সরকারকে চাকরির বয়সসীমা নিয়ে নতুন করে ভাবা প্রয়োজন। ২০২০ সালের শুরুতে যাদের বয়স ছিল ৩০ বছর, সরকারি নিয়মানুযায়ী সেটাই ছিল চাকরির দরখাস্ত করার শেষ সময়। এখন আর তারা দরখাস্ত করতে পারছেন না।

“কিন্তু করোনার কারণে যাদের জীবন থেকে দেড়-দুই বছর অপচয় হলো, তাদের চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগটি তো দিতে হবে, এমনটি অনেকে ভাবছেন।”

এই প্রেক্ষাপটে চাকরিপ্রত্যাশী তরুণেরা যে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর দাবি করেছেন, তা যৌক্তিক বলে আমি মনে করি।

তারা এ দাবি নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছেন, কিন্তু কী হবে কেউ কিছু জানে না ! সবমিলে দেশের পরিকাঠামো দেখলে হতাশ হওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে ?

তারপরও তরুণ সমাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়ছে। জাহাজ সাগরে ডুবে যাবার ফলে ভাসমান অবস্থায় ধরা খেয়ে আফ্রিকায় আটকে আছে,কী হবে শেষ পর্যন্ত কেউ তা জানে না। তারা কি শেষ পর্যন্ত পারবে তাদের সেই স্বপ্নের দেশে পৌঁছাতে!

অথচ প্রতিদিন নানাভাবে জানছি যেমন ফিনল্যান্ড, পর্তুগাল যোগ্য এবং দক্ষ লোক খুঁজছে তাদের দরকারে। আমাদের দেশি ভাষায় বলে- “তেলো মাথায় সবাই তেল দিতে চায় কিন্তু যার মাথায় তেল নাই তাকে কেউ তেল দেয় না।”জাতি হিসেবে এটা আমাদের চরিত্রের একটি বিশেষ সনদপত্র।

বিশ্ব যোগ্য এবং দক্ষ লোক খুঁজছে অথচ যেসব লোক নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাত সাগর আর তেরো নদী পাড়ি দিয়ে আসছে তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না। কেউ কি একবার ভাবছে না এদের যোগ্যতা নিয়ে ? এতবড় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা নতুন জীবনের সন্ধানে মা-বাবা, ভাই-বোন এবং মাতৃভূমি ত্যাগ করেছে তাদের চেয়ে দক্ষ এবং যোগ্য ব্যক্তি অন্য কেউ কীভাবে হতে পারে ?

হয়তো এসব ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জীবনে পুঁথিগত বিদ্যার উপর সনদপত্র নেই কিন্তু যে মনোবল এবং কঠিন পরিশ্রম তাদের দৈনিক শিক্ষায় রয়েছে সেটা কি যথেষ্ট নয়, বিশ্বকে ভালো কিছু দেবার জন্য ?অবশ্যই আছে। তাহলে এসব আত্মত্যাগী পরিশ্রমী মানুষের জন্য সরকার সুপারিশ করছে না কেন বিশ্বকে , যে এদেরকে তোমরা কাজে লাগাও,।

পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে”? গোটা বিশ্ব তো জেনে গেছে এরা বাংলাদেশি,জেনে যখন গেছেই তাহলে কেন সেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতগুলো এদের হয়ে সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না, আর কেনই বা সরকার রাষ্ট্রদূতগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছে না এদের জীবনের নিশ্চয়তার জন্য কাজ করতে ?

আমি একটি জিনিস বেশ লক্ষ্য করছি , বিশ্বে পুঁথিগত শিক্ষিত লোকের অভাব নেই তবে যোগ্য ব্যক্তির বড্ড অভাব। যার ফলে ফিনল্যান্ড বা পর্তুগালের মতো অনেক দেশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে তাদের নিজ দেশকে ম্যানেজ করতে।

যেসব কাজের জন্য এসব দেশ সাহায্য আশা করছে তার সব কাজই রয়েল বাংলার টাইগারা করতে পারবে, শতভাগ গারান্টি দিয়ে আমি বলতে পারি। শুধু দরকার স্বল্প সময়ে কিছু অল্প শিক্ষা সেটা হলো ভাষাগত দুর্বলতা আর ম্যানার যা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় সম্পন্ন করা সম্ভব।

যেসব তরুণ সমাজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছেড়েছে বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য তাদেরকে সে সুযোগ পেতে সকল স্তরের মানুষের প্রতি আহ্বান করছি।

আজ এসেছি সাতরাতে একটি লেকে , হঠাৎ দেখি অনেক তরুণ ,এরা সবাই আফগানিস্তানের। তারা তাদের দেশ ছেড়েছে দেশে অশান্তির কারণে।

তাদের লাইফস্টাইল দেখে মনে হলো না তারা আফগান, কিন্তু সুইডিশ ভাষাটাও ঠিকমতো বলতে পারে না,যদিও বসবাস করছে বহু বছর ধরে। তাদের ফ্যাশনে সমস্যা নেই।

এ পর্যন্ত খুব কম বাংলাদেশিকে দেখেছি যার হয়তো আফগানদের মতো ফ্যাশন নেই তবে সে বেকার হয়ে ঘুরছে না , কোথাও না কোথাও কাজ করছে কম পক্ষে সেভেন ইলেভেন সময়ে ।

এতটুকু গর্ব অনুভব করি যখন দেখি দূরপরবাসী বাংলাদেশি তার দেশের কথা ভাবে এবং তার দেশকে ভালোবাসে। কারণ, বাঙালির রক্তে বইছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লিখা (বনলতা সেনের মনের কথা)—ভায়ের মায়ের এত স্নেহ, কোথায় গেলে পাবে কেহ, ও মা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি, “আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।

  • লেখক: রহমান মৃধা।
  • সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, [email protected]