ঢাকাWednesday , ৩০ জুন ২০২১

করোনা, সর্বাত্মক লকডাউন ও বাস্তবতা : সেলিম আহমেদ

নিউজ পোর্টাল ২৪
জুন ৩০, ২০২১ ১১:৪১ পূর্বাহ্ন
Link Copied!

মতামত:: প্রিয় বাংলাদেশে আবারো আগ্রাসী রূপে ফিরেছে প্রলয়ংকারী করোনা। প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় থেকে অদৃশ্য এই ভাইরাসটি সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত বাংলাদেশসহ পুরো দুনিয়া। কিছুদিন শান্ত থাকার পর চলতি মাসের শুরু থেকে দেশে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটি।

ইতোমধ্যেই রাজশাহী ও খুলনায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৫৭টি জেলাই রয়েছে উচ্চ ঝুঁকিতে। সংক্রমণ অপ্রতিরোধ্য গতিতে দেশের প্রতিটি হাসপাতালেই বেড়েছে চাপ। অনেক হাসপাতালেই নতুন রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। মানুষ চিকিৎসার জন্য হাহাকার করে মারা যাচ্ছে। ঢাকার অবস্থাও ক্রমেই নাজুক হচ্ছে। অনেক হাসপাতালই রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি আরো কয়েক সপ্তাহ অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তখন পরিস্থিতি আরো ভয়বাহ হবে বলে মনে করছেন তারা।

এই লকডাউনে কত মানুষকে দেখেছি চাকরি হারাতে। দীর্ঘদিনের জমানো সঞ্চয় ও রোজগারের পথ হারিয়ে নিঃস্ব হতে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় আসবাবপত্র নিয়ে ট্রাকে করে গ্রামে যেতে। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানো মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কায় এসে আবারো বিপর্যস্ত হয়েছেন। এবার তৃতীয় ধাক্কা কীভাবে সামলাবেন সেই চিন্তায় দিনপার করছেন সর্বশ্রেণীর মানুষ।

করোনার এই ঊর্ধ্বগতি লাগাম ঠেনে ধরতে ‘কঠোর লকডাউনের’ বিকল্প নেই; এই শব্দটি স্পষ্টভাবে বার বার বলে আসছেন দেশের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। কারণ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধের প্রথম উপায় মানুষে–মানুষে সংস্পর্শ এড়ানো, মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এই পন্থা অবলম্বন করে করোনা নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু আমরা তা পারি নি। কেন পারিনি তা কর্তা ব্যক্তিরাই ভালো জানেন। আমরা লকডাউন দিয়েছি কিন্তু বৈজ্ঞানিক প্রন্থায় বাস্তবায়ন করতে গিয়ে একাধিকবার ভুল করেছি। অপরিকল্পিত লকডাউন ও পদে পদে দৃশ্যমান সমন্বয়হীনতা খেসারত দিতে হচ্ছে আজ পুরো বাংলাদেশকে।

দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার তীব্রতা আরো বাড়বে। আগামী সপ্তাহ নাগাদ দেশে পুরোদমে দেখা দিবে করোনার তৃতীয় ঢেউ। তা সামাল দেয়া অনেকটা দুঃসহ হয়ে উঠবে বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ঢেউ চলকালীন সময়ে আমারা দেখেছি ঢাকাসহ সারাদেশে কী ভয়াবহতা।

এখন আবারো বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়ার পেছনে সরকারের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করেন অনেক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যখন মহামারির তুঙ্গ দশা, তখন সীমান্তকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন তারা। আমাদের জন্য বিপদটা অনিবার্য জেনেই সতর্ক করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু আমরা পাত্তাই দেইনি। না মানুষ, না প্রশাসনের কর্তাব্যক্তি। সীমান্ত কাগজে-কলমে বন্ধ রাখলেও চোরাই পথ দিয়ে মানুষ ভারতে অবাদে যাতায়াত করেছেন।

ভারত থেকে ফিরে ঠিকমতো অনেকে মানেননি হোম কোয়ারেন্টাইন। আবার অনেক শনাক্ত রোগী পালিয়েছেন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন থেকে। সীমান্তের অতিসংক্রমিত জেলাগুলোতে স্থানীয়ভাবে কঠোর লকডাউন দেয়া হলে তা তোয়াক্কা করেননি কেউ। এক জেলা থেকে ছুটে গেছেন অন্য জেলায়। যার ফলে করোনায় অতিভয়াবহ ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে দেশজুড়ে।

সর্বশেষ আইইডিসিআর-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে বর্তমানে শনাক্তদের ৮০ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত।

এমন সংকটসময় পরিস্থিতিতে এসে আবারো ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ দিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার থেকে এক সপ্তাহের শুরু হবে এই লকডাউন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বাড়তে পারে লকডাউনের সময়কাল। মানুষ বাঁচাতে অন্যবারের তুলনায় এবার হার্ডলাইনে সরকার। অতি জরুরী প্রয়োজ ছাড়া ঘর থেকে বের হলে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। কঠোর এই বিধিনিষেধগুলো বাস্তবায়ন করতে পুলিশ-বিজিবির সঙ্গে মাঠে থাকবে সেনাবাহিনীও।

সরকার যতই কঠোর লকডাউন কিংবা কড়াকড়ির কথা বলুক না কেন তা বাস্তবায়ন করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। কারণ, বাস্তবতা বড়ই কঠিন। এবার যখন কঠোর লকডাউন আরোপ করা হবে এমন ঘোষণা দেয়া হলো তারপরই দেখেছি ঈদযাত্রার মতো মানুষ ছুটেছে গ্রামের পথে। দূরপাল্লার পরিবহন নেই, পথে পথে পোহাতে হবে অসহনীয় দুর্ভোগ আর শত বিপত্তি এমন চিন্তা মাথায় রেখেই অতিরিক্ত টাকা খরচ করে নগর ছেড়েছে মানুষ। প্রাণের ঝুঁঁকি নিয়েও ফেরিতে ভিড়, ছোট ছোট গাড়িতে ঠাঁসাঠাসি করে স্বাস্থ্যবিধি না মেনে যাওয়ার কারণে নিজেরা সংক্রমিত হওয়ার পাশাপাশি গ্রামে-গঞ্জে আরো ব্যাপকভাবে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যারা এতসব কষ্ট উপেক্ষা করে বাড়িতে যাচ্ছে কিংবা লকডাউন না মেনে রাস্তায় বের হয় তাদের রয়েছে যৌক্তিত কিছু উত্তর। রয়েছে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন। যাদের দিন এনে দিনে খায় তাদের কাছে জীবনের থেকে জীবিকার প্রশ্ন আগে। যারা লকডাউনের ঘোষণার পর বাড়িতে যাচ্ছেন তাদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আত্মসামাজিক বাধ্যবাধকতা, রোজগারের অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক সমস্যা, খরচ যোগানোর চিন্তা- এমন নানা কারণে তারা ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। তারা বলছেন, গ্রামে গেলে অন্তত খাওয়াটা পাবে। ঢাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা নেই বলেই বাড়িতে যাচ্ছেন।

এদের জোর করে আটকালেও কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। যদি সরকারিভাবে অর্থনৈতিকভাবে তাদের সহযোগীতা করা যেত তাহলে হয়তো আটকে রাখা যেত।

এই দিনে আনা দিনে খাওয়া নিম্নআয়ের মানুষের পাশাপাশি অনেক সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদেরও বাড়িতে যেতে দেখা গেছে। তারা কিন্তু করোনার ভয়ে নয়, বেতন-বোনাস আমোদে ভোগ করতে গ্রামে যাচ্ছেন।

গত লকডাউনে নিষেধাজ্ঞা অম্যান্য করে রাস্তায় বের হওয়া অনেক মানুষ জানিয়েছিলেন, ঘরে বসে থাকলে তাদের খাবার দিবে কে? তাই জীবিকার যোগান দিতেই রাস্তায় বের হয়েছেন। সরকারও মানুষের জীবিকার প্রশ্নে আগের লকডাউনগুলোতে ছাড় দিয়েছিল।

এই লকডাউনে কত মানুষকে দেখেছি চাকরি হারাতে। দীর্ঘদিনের জমানো সঞ্চয় ও রোজগারের পথ হারিয়ে নিঃস্ব হতে। দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় আসবাবপত্র নিয়ে ট্রাকে করে গ্রামে যেতে। করোনার প্রথম ধাক্কা সামলে ঘুরে দাঁড়ানো মানুষ দ্বিতীয় ধাক্কায় এসে আবারো বিপর্যস্ত হয়েছেন।

এবার তৃতীয় ধাক্কা কীভাবে সামলাবেন সেই চিন্তায় দিনপার করছেন সর্বশ্রেণীর মানুষ। করোনার জেরে দেশে বাড়ছে দারিদ্রতার সংখ্যা। করোনাকালে নতুন করে দেশে দরিদ্র হয়েছে আড়াই কোটি মানুষ। আগের দুই কোটিতো ছিলই। করোনা ঠেকাতে লকডাউনের কারণে অর্থনীতির যা অবস্থা তাতে মধ্যবিত্তও বিত্তহীন হতে চলেছেন।

তারপরও লকডাউন কিংবা কঠোর পন্থা অবলম্বন করে আমাদের জীবনকে বাঁচাতে হবে পাশাপাশি জীবিকাকেও ঠিকিয়ে রাখতে হবে। তাই পরিস্থিতি উত্তরণে এই লকডাউনের পর বিকল্প বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। মানুষকে মাস্ক পরাতে ও স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করতে হবে। তাদের আরো সচেতন করতে হবে। একই সঙ্গে দ্রুত যাতে দেশের সব মানুষকে টিকা দেয়া যায় সেই উদ্যোগকে আরো ত্বরান্বিত করতে হবে। অন্যতায় অন্যতায় পরিস্থিতি আরো জটিল হবে।

  • সেলিম আহমেদ,
    সাংবাদিক।
    ইমেইল: [email protected]