ডেস্ক রিপোর্ট:: ‘মা’ -সব থেকে মধুর শব্দ আর হয় না। ছোট শব্দটির গভীরতা পরিমাপ করা যায় না, যাবে না। মা সন্তানের জন্য পৃথিবীতে মহান স্রষ্টার আশির্বাদ স্বরুপ। পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে কেউ আপন নয়। মাকে নিয়ে লিখে শেষ করা যাবে না।
মায়ের কোল একজন সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে বিশ্বস্ত আশ্রয়স্থল। আজ রোববার, বিশ্ব মা দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আজকের এ দিনটিতে মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা প্রকাশ করছে। কিন্তু দিবসের খোলসে নিশ্চয় মা দিবস আটকে থাকার মতো বিষয় নয়। বিশ্বের অনেক অঞ্চলে বিভিন্ন দিনে, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল বা মে মাসেও মা দিবস উদযাপন করা হয়।
মা হচ্ছেন একজন পূর্ণাঙ্গ নারী, যিনি গর্ভধারণ, সন্তানের জন্ম তথা সন্তানকে বড় করে তোলেন- তিনিই অভিভাবকের ভূমিকা পালনে সক্ষম ও মা হিসেবে সর্বত্র পরিচিত। প্রকৃতিগতভাবে একজন নারী বা মহিলাই সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। গর্ভধারণের মতো জটিল বিষয়টি একমাত্র মায়ের পক্ষেই সম্ভব, তাই সামাজিক, সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় অবস্থান থেকেও মাকে বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব মা দিবস-
মার্কিন কংগ্রেসে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ মে, মে মাসের দ্বিতীয় রোববারকে ‘মা দিবস’ হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। আর তখন থেকেই এই দিনে সারা বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে মা দিবস। বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হয়। কথিত আছে, ব্রিটেনেই প্রথম শুরু হয় মা দিবস পালনের রেওয়াজ, কেননা সেখানে প্রতিবছর মে মাসের চতুর্থ রোববারকে মাদারিং সানডে হিসেবে পালন করা হত। তবে সতের শতকে মা দিবস উদযাপনের সূত্রপাত ঘটান মার্কিন সমাজকর্মী জুলিয়া ওয়ার্টস। মায়ের সঙ্গে সময় দেওয়া আর মায়ের জন্য উপহার কেনা ছিল তার দিনটির কর্মসূচিতে।
এরপর যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে প্রথম মা দিবস পালন করা হয় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২ জুন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন সর্বপ্রথম মা দিবসকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন। মা দিবসের উপহার সাদা কার্নেশন ফুল খুব জনপ্রিয়। আর বাণিজ্যিকভাবে, ‘মা দিবস’ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কার্ড আদান-প্রদানকারী দিবস। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ‘মা দিবস’ এ অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি ফোন করা হয়।
ইসলাম ধর্মে মা-
আল কুরআনে বলা হয়েছে আমি মানুষকে তাদের পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার জোর নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জোর প্রচেষ্টা চালায়, যার সম্পর্কে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য প্রকাশ করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দেব যা কিছু তোমরা করবে।
একটি হাদীসে নবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত (স্বর্গ)।
হিন্দু ধর্মে মা-
সনাতন ধর্মে উল্লেখ আছে স্ববংশবৃদ্ধিকামঃ পুত্রমেকমাসাদ্য..। আবার সন্তান লাভের পর নারী তার রমণীমূর্তি পরিত্যাগ করে মহীয়সী মাতৃরূপে সংসারের অধ্যক্ষতা করবেন। তাই মনু সন্তান প্রসবিনী মাকে গৃহলক্ষ্মী সম্মানে অভিহিত করেছেন। তিনি মাতৃ গৌরবের কথা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন এভাবে- উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা। সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে” [ (মনু,২/১৪৫) অর্থাৎ ‘দশজন উপাধ্যায় (ব্রাহ্মণ) অপেক্ষা একজন আচার্যে্যর গৌরব অধিক, একশত আচার্য্যর গৌরব অপেক্ষা পিতার গৌরব অধিকতর; সর্বোপরি, সহস্য পিতা অপেক্ষা মাতা সম্মানার্হ।’
ক্যাথলিক ধর্মে, দিনটি বিশেষভাবে ভার্জিন মেরি বা কুমারী মাতার পূজায় সমর্পিত।
কাব্য সাহিত্যে মা-
মাকে নিয়ে অনেক গান, কবিতা, গল্প, কাহিনী রচিত হয়েছে। যেমন :
গান-
মাগো মা ওগো মা, আমারে বানাইলি তুই দিওয়ানা – খুরশীদ আলম
মায়ের একধার দুধের দাম কাটিয়া গায়ের চাম – ফকির আলমগীর
এমন একটা মা দে না – ফেরদৌস ওয়াহিদ
রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস – জেমস
ওই আকাশের তারায় তারায় – রাশেদ
ছেলে আমার মস্ত বড় মস্ত অফিসার – নচীকেতা ঘোষ
পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব মাগো – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
কয়েকটি কবিতার শিরোনাম-
মায়ের প্রতি ভালবাসা- মুহাম্মদ হাবীব উল্লাহ
আমাদের মা- হুমায়ুন আজাদ
মা – কাজী নজরুল ইসলাম
বীরপুরুষ/মনে পড়া/লুকোচুরি – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কখনো আমার মাকে- শামসুর রাহমান
কত ভালবাসি- কামিনী রায়
আসুন জেনে নিই কোন দেশ কোন দিনে এই দিবসটি পালন করে –
ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় রবিবার- নরওয়ে।
৩রা মার্চ- জর্জিয়া (রাষ্ট্র)।
৮ই মার্চ- আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, কসোভো, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, বেলারুশ, বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা, ম্যাসেডোনিয়া প্রজাতন্ত্র, মলদোভা, রোমানিয়া, মন্টিনিগ্রো, মরোক্কো, রাশিয়া, স্লোভেনিয়া, সার্বিয়া, তাজিকিস্তান, ভিয়েতনাম, বুলগেরিয়া, কাজাখস্তান, লাওস।
১০ই মার্চ- যুক্তরাজ্য।
১৪ই মার্চ- নাইজেরিয়া।
২১শে মার্চ- বাহরাইন, মিশর, জর্দান, কুয়েত, লিবিয়া, লেবানন, ওমান, ফিলিস্তিনী অঞ্চলসমূহ, কাতার, ইসরায়েল, সৌদি আরব, সুদান, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন (সাধারণভাবে সব আরব দেশসমূহ), ইরাক।
২৫শে মার্চ- স্লোভেনিয়া।
৩রা এপ্রিল- প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড।
৭ই এপ্রিল- আর্মেনিয়া।
মে মাসের প্রথম রবিবার- হাঙ্গেরি, লিথুয়ানিয়া, মোজাম্বিক, পর্তুগাল, স্পেন।
৮ই মে- দক্ষিণ কোরিয়া (মাতাপিতা দিবস)।
মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার- বাংলাদেশ, এ্যাঙ্গুইলা, আরুবা, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, বাহামা দ্বীপপুঞ্জ, বার্বাডোস, বেলজিয়াম, বারমুদা, বোনাইর, বতসোয়ানা, ব্রাজিল, ব্রুনাই, কানাডা, কম্বোডিয়া, চিলি, চীন, কলম্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কিউবা, কুরাকাও দ্বীপ, সাইপ্রাস, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ডোমিনিকা, ইকুয়েডর, ইস্তোনিয়, ইথিওপিয়া, ফিজি, ফিনল্যান্ড, জার্মানি, গোল্ড কোস্ট (ইংরেজ উপনিবেশ), গ্রিস, গ্রানাডা, গায়ানা, হন্ডুরাস, হং কং, আইসল্যান্ড, ভারত, ইতালি, জামাইকা, জাপান, লাতভিয়া*, লিশ্টেনশ্টাইন*, Macao, মালয়েশিয়া, মাল্টা, বার্মা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, পাপুয়া নিউ গিনি, পেরু, ফিলিপাইন, পুয়ের্তো রিকো, সেন্ট কিট্স ও নেভিস, সেন্ট লুসিয়া, সেন্ট ভিনসেন্ট ও গ্রেনাডাইন দ্বীপপুঞ্জ, সামোয়া, সিঙ্গাপুর, Sint Maarten, স্লোভাকিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, সুরিনাম, সুইজারল্যান্ড, প্রজাতন্ত্রী চীন, তাঙ্গানিকা, টোঙ্গা, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো, তুরস্ক, উগান্ডা, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র, উরুগুয়ে, ভিয়েতনাম, ভেনেজুয়েলা, জাম্বিয়া, জিম্বাবুয়ে।
১৫শে মে- প্যারাগুয়ে (same day as Día de la Patria)।
২৬শে মে- পোল্যান্ড ।
২৭শে মে- বলিভিয়া।
মে মাসের শেষ রবিবার- আলজেরিয়া, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স(জুন মাসের প্রথম রবিবার যদি পেন্টেকস্ট এই দিনে হয়), ফ্রান্সফরাসি এন্টিলস (জুন মাসের প্রথম রবিবার যদি পেন্টেকস্ট এই দিনে হয়), হাইতি, মরিশাস, সুইডেন, তিউনিসি।
৩০শে মে- নিকারাগুয়া।
১লা জুন- মঙ্গোলিয়া (মাতৃ ও শিশু দিবস)।
জুন মাসের দ্বিতীয় রবিবার- লুক্সেমবুর্গ।
জুন মাসের শেষ রবিবার- কেনিয়া।
১২ই আগস্ট- থাইল্যান্ড (রানী সিরিকিত এর জন্মদিন)।
১৫ই আগস্ট- কোস্টা রিকা, অ্যান্ট্ওয়ার্প (বেলজিয়াম)।
অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সোমবার- মালাউই।
১৪ই অক্টোবর- বেলারুশ।
অক্টোবর মাসের তৃতীয় রবিবার- আর্জেন্টিনা (Día de la Madre)।
নভেম্বর মাসের শেষ রবিবার- রাশিয়া।
৩রা নভেম্বর- পূর্ব টিমোর।
৮ই ডিসেম্বর- মপানামা।
২শে ডিসেম্বর- ইন্দোনেশিয়া।
১৯শে এবং ২৯শে এপ্রিলের মাঝে- নেপাল।
২৪শে মে, ২০১১, ১২ই মে, ২০১২- ইরান।
মা দিবসের চাওয়া-
প্রত্যেক মা-বাবা তাদের সন্তানদের স্বার্থহীনভাবে লালন পালন করেন। নিজের সামর্থের সর্বোচ্চটা দিয়ে তারা সন্তানের ইচ্ছা পূরণ করার চেষ্টা করেন। প্রত্যেক সন্তান তার মা-বাবার কাছে চির ঋণী। যে ঋণ কোনো কিছুর বিনিময়ে শোধ করার নয়। তাই আমাদেরও উচিত মা-বাবাকে তাদের প্রাপ্ত সম্মান দেওয়া। কোনো অবস্থায়ই তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। এমন কাজ করা যাবে না যাতে তারা মনে কষ্ট পায়। কোনো মতেই তাদের মনে কষ্ট দেওয়া যাবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে। বেঁচে থাকলে আমরাও মা-বাবা হব। আর আমাদের মা-বাবার মতো সময় আমাদেরও একদিন আসবে। আমরা আমাদের মা-বাবার সাথে কি ধরনের ব্যবহার করছি বা তাদের সাথে আমাদের কি ধরনের সম্পর্ক তা কিন্তু আমাদের সন্তানেরা দেখেন এবং সেখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেন। তাই নিজের মা-বাবার সাথে কোন ধরনের ব্যবহার করছেন তা একটু চিন্তা করবেন এবং চোখ বুজে ভবিষ্যতের চিত্রের দিকে একটু তাকানোর চেষ্টা করবেন।
বৃদ্ধাশ্রমে অনেক মা-বাবা সন্তানদের ছেড়ে বহু কষ্টে দিন যাপন করেন। একটিবার তাদের স্থানে নিজের কথা চিন্তা করে দেখুন। যৌবনেই চিন্তা করুন বৃদ্ধ বয়সে আপনার সন্তানেরা আপনাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখলে কেমন লাগবে। মা দিবসের স্লোগান হোক একটাই আর তা হল- সন্তান থাকতে বৃদ্ধাশ্রম যেন একজন মা-বাবারও আশ্রয়স্থল না হয়।