ঢাকাTuesday , ১৩ এপ্রিল ২০২১

মাহে রমযানের গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়: আরিফুল হক এনামী

নিউজ পোর্টাল ২৪
এপ্রিল ১৩, ২০২১ ৪:০৪ পূর্বাহ্ন
Link Copied!

মাহে রমযানের গুরুত্ব ও আমাদের করণীয়:

মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“হে ইমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর। যাতে তোমরা পরহেজগারী অর্জন করতে পার।
(সূরা বাকারা:১৮৩)।
সওম বা সিয়ামের শাব্দিক অর্থ বিরত থাকা। শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর নির্দেশ পালনের উদ্দেশে নিয়তসহ সুবহে সাদিকের শুরু থেকে সূর্যাস্তের পর পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকাকে সাওম বলে। যাকে আমরা ফার্সি প্রতিশব্দে রোযা বলে থাকি। আর মুসলিম উম্মাহর জন্য আরবী মাসসমূহের ৯ম মাস রমযান মাসে সিয়াম পালন করা ফরয। এই মাহে রমজানের ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন:, “রমজান মাসই হলো সেই মাস যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যয় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।

(সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

রোজার ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) এর ভাষায় অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

(ক) আবু হুরায়ারা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) ইরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয।
(সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

(খ) ইবনে সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) ইরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতীত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।
(বুখারি, মুসলিম)

(গ) আবু হুরায়ারা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রোজা রাখবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়তে রমজান মাসের রাতে ইবাদত করে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি ইমানের সঙ্গে ও সওয়াবের নিয়ত কদরের রাতে ইবাদত করে কাটাবে তার পূর্বের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় হবে।
(বুখারি, মুসলিম)

(ঘ) রসুল (সা:) আরো বলেন: আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, রোজা ছাড়া আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজই তার নিজের জন্য। তবে রোজা আমার জন্য। আমি নিজেই এর পুরস্কার দেব। রোজা (জাহান্নামের আগুন থেকে বাচার জন্য) ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ রোজা রেখে অশ্লীল কথাবার্তায় ও ঝগড়া বিবাদে যেন লিপ্ত না হয়। কেউ তার সঙ্গে গালমন্দ বা ঝগড়া বিবাদ করলে শুধু বলবে, আমি রোজাদার। সেই মহান সত্তার কসম যার করতলগত মুহাম্মদের জীবন, আল্লাহর কাছে রোজাদারের মুখের গন্ধ কস্তুরীর সুঘ্রাণের চেয়েও উত্তম। রোজাদারের খুশির বিষয় ২টি-যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার রবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে।
(বুখারি)

(ঙ) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল (সা:) বলেছেন, রোজা এবং কোরআন (কেয়ামতের দিন) আল্লাহর কাছে বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে (রমজানের) দিনে পানাহার ও প্রবৃত্তি থেকে বাধা দিয়েছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের বেলায় নিদ্রা হতে বাধা দিয়েছি। সুতরাং আমার সুপারিশ তার ব্যাপারে কবুল করুন। অতএব, উভয়ের সুপারিশই কবুল করা হবে (এবং তাকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে)। (সুনানে বায়হাকি)

এ মাসটি এমন বরকতময় মাস যে, এ মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এ মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো।
হাদিসে আরও বর্ণিত, এ মাসে যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবে তা তার জন্য গুনাহ মাফের এবং দোযখের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে।

(১) রোযা রাখা: আল্লাহ তাআলা বলেন:, হে ঈমানদারগণ, তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা মুত্তাকী হতে পারো।
(সূরা বাকারা : ১৮৩)

আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন তোমরা রমজানের চাঁদ দেখবে তখন রোযা রাখবে। যখন শাওয়ালের চাঁদ দেখবে তখন থেকে রোযা বন্ধ করবে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে ত্রিশ দিন রোযা রাখবে।
(সহীহ বুখারী)

অতএব রমজানের রোযা প্রত্যেক সুস্থ, মুকীম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ এবং হায়েয-নেফাসমুক্ত প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ওপর ফরজ। শরয়ী ওযর ছাড়া এ মাসের একটি রোযাও কোনো মুসলমান ইচ্ছাকৃতভাবে না রাখলে জঘন্য অপরাধী সাব্যস্ত হবে। দীনের মৌলিক বিধান লঙ্ঘনকারী ও ইসলামের ভিত্তি বিনষ্টকারী হিসাবে গণ্য হবে এবং কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।

(২) তারাবীহ নামাজ পড়া: রমযান মাসে দিনের ইবাদত হলো রোযা যা শরীয়তে ফরজ, আর রাতের ইবাদত হলো তারাবীহ নামাজ যা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাসের সাথে সওয়াবের আশায় রমজানের রাতে তারাবীহ আদায় করে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
(সহীহ বুখারী)

(৩) কোরআন তেলাওয়াত করা: রমজান মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে। তাই নবী (সা:) রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াতের খুব গুরুত্ব দিতেন। এ প্রসঙ্গে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সবচেয়ে বেশি দানশীল ও বদান্য, রমজানে তাঁর দানশীলতা ও বদান্যতা অনেক বেড়ে যেত। প্রত্যেক রমজানে জিবরাঈল আ. তাঁর সঙ্গে মিলিত হতেন এবং পুরো কোরআন একে অপরকে শোনাতেন।
(সহীহ বুখারী)
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাদি. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রোযা এবং কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে রব, আমি তাকে খাদ্য এবং যৌন সম্ভোগ থেকে বিরত রেখেছি, অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। কোরআন বলবে, আমি তাকে রাতের ঘুম থেকে বিরত রেখেছি (অর্থাৎ না ঘুমিয়ে সে তেলাওয়াত করেছে) অতএব তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তাদের উভয়ের সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।
(মুসনাদে আহমাদ)

(৪) সাহরী খাওয়া: রোযার প্রস্তুতির জন্য যে আহার করা হয় তার নাম সাহরী। সাহরী খাওয়া সুন্নত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা সাহরী খাও। কেননা, সাহরীতে বরকত রয়েছে।
(সহীহ মুসলিম)

(৫) ইফতার করা: সারা দিন রোযা রাখার পর সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে যে আহার করা হয় তার নাম ইফতার।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, লোকেরা যতদিন প্রথম সময়ে ইফতার করার বিষয়ে যত্নবান হবে ততদিন তারা কল্যাণের পথে থাকবে।
(সহীহ বুখারী)

(৬) রোযাদারকে ইফতার করানো: যায়েদ ইবনে খালেদ রাদি. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, সে তার (রোযাদারের) অনুরূপ প্রতিদান লাভ করবে। তবে রোযাদারের প্রতিদান থেকে বিন্দুমাত্রও হ্রাস করা হবে না।
(সুনানে তিরমিযী)

(৬) তাওবা-ইস্তিগফার করা: আল্লাহ তা’আলা এ মাসে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেন। তাই আমাদের কর্তব্য তাওবা-ইস্তিগফার করা। কেননা, যে ক্ষমা চায় তাওবা করে তাকেই আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। রাসূল (সা:) ইরশাদ করেন: আল্লাহ এ মাসের প্রতিরাতে অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দান করেন।
(মুসনাদে আহমাদ)

(৮) দুআ করা: এ মাস দুআ কবুলের মাস। তাই আমাদের উচিত বেশি বেশি দুআ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, প্রত্যেক মুসলিম (রমজানে) যে দুআ করে তা কবুল করা হয়।(মুসনাদে বাযযার)

(৯) রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করা: আয়েশা (রা.) বলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃত্য পর্যন্ত রমাযানের শেষ দশকের ইতিকাফ করেছেন। এরপর তার পূণ্যবতী জীবন সঙ্গিনীগণও ইতিকাফ করেছেন। (বুখারী, মসলিম]
ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ইতিকাফকারী সর্ব প্রকার পাপ হতে মুক্ত থাকে এবং অন্যরা বাইরে আমল করে যে নেকী লাভ করে সে ইতিকাফে থেকে বাইরের আমলগুলো না করেও সেই পরিমাণ নেকী লাভ করে।
(সুনানে ইবনে মাজাহ)

(১০) অশ্লীল কথা, মিথ্যা কথা, অনর্থক কথা বা কাজ ও গীবত ইত্যাদি পরিহার করা। রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, যে রোযা রেখেছে অথচ মিথ্যাচার পরিহার করেনি, তার এই কৃত্রিম পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন আল্লাহর নেই।
(সহীহ বুখারী)
আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূল (সা:) ইরশাদ করেছেন, রোযা শুধু পানাহার বর্জন করার নাম নয়; বরং রোযা হলো অনর্থক কথা ও কাজ এবং অশ্লীল কথা বর্জন করা।
(মুসতাদরাকে হাকেম)

আসুন! মাহে রমজানের ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধি করে আগত মাহে রমজানের হক আদায় করে ইবাদত করতে পারলে আমরা পাব আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি, রহমত, মাগফেরাত ও জাহান্নাম হতে নাজাত। আল্লাহ আমাদের সবাইকে পবিত্র রমজানের ফজিলত ও তাৎপর্য অনুধাবন করে সুন্দর ও সঠিকভাবে ইবাদত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

আরিফুল হক এনামী
প্রভাষক,
আধুনগর ইসলামিয়া কামিল মাদরাসা
খতিব,
শাহ ছমিউদ্দিন রহ. জামে মসজিদ
লোহাগড়া, চট্টগ্রাম।