ডেস্ক রিপোর্ট: ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিজেপি একটি গানের ভিডিও প্রকাশ করেছে; যেখানে বাংলাদেশে এক হিন্দু কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনা, বাংলাদেশের টিভি থেকে নেওয়া ছবি, ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।
সম্প্রতি কলকাতার কিছু নামকরা গায়ক-অভিনেতা বিজেপির চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করে একটি গানের ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। মনে করা হচ্ছে বিজেপির সাম্প্রতিক ভিডিওটি তারই পাল্টা উদ্যোগ।
বিজেপি বলছে, তারা ৪৭-এর দেশভাগ থেকে শুরু করে ইসলামী জঙ্গিদের কার্যকলাপ মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের তার জন্য বাংলাদেশের কয়েকটি ঘটনার প্রসঙ্গ আনা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশের কিছু মানুষ মনে করছেন প্রতিবেশি দেশের নির্বাচনে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে।
ভারতীয় জনতা পার্টি পশ্চিমবঙ্গে তাদের নির্বাচনী প্রচারের অঙ্গ হিসাবে বুধবার যে গানের ভিডিও প্রকাশ করেছে। তার শুরুতেই আছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় মন্ত্রী – গায়ক বাবুল সুপ্রিয়। যিনি কলকাতার একটি কেন্দ্র থেকে এবারের ভোটে লড়ছেন।
ভিডিওটি দেখতে দেখতে যেটা চোখে পড়ছে, তা হল বাংলাদেশের এক হিন্দু কিশোরীর ধর্ষণের ঘটনা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও ইসলামপন্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ছবি এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলার ঘটনা সংক্রান্ত খবরের কাগজের কাটিং দেখা যাচ্ছে।
তুলে আনা হয়েছে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে আরব গেরিলাদের প্রসঙ্গ। যেখানে ব্যবহার করা হয়েছে ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর একটি পতাকার ছবি।
ভিডিওটিতে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের একটি টিভি স্টেশনের লোগোসহ ছবিও ব্যবহার করা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, যেসব ছবি ব্যবহার বা ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করা হয়নি।
শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ওই ভিডিওতে কিন্তু বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কিছু নেই। ভারত বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক খুবই ভাল। আমাদের অবস্থান একটা নির্দিষ্ট মানসিকতার বিরুদ্ধে। আমরা চাই না জামাতি চিন্তাধারা পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে লালিত পালিত হোক। সীমান্তের ওদিক থেকে কিছু মানুষ যে ধরনের মগজ ধোলাই চালাচ্ছেন আমাদের এদিকে, আমরা সেই মানসিকতার বিরোধী।
তিনি আরও উল্লেখ করছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা এই পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে বসেই তো হয়েছিল। খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণ তো সেই চক্রান্তেরই অংশ ছিল। সেসব তো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও তো এইসব মৌলবাদী-উগ্রবাদীরা সক্রিয়!
তিনি বলেন, উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগণায় একটা গান খুব শোনা যায়: এগিয়ে চলো এগিয়ে চলো; ঝাঁপিয়ে পড়ো ঝাঁপিয়ে পড়ো, বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়ো; শেখ হাসিনার গলায় দড়ি টানো, শেখ হাসিনাকে ফাঁসিতে তোলো। এধরনের গান যারা গায়, আমরা তাদের বিরুদ্ধে।
সামাজিক মাধ্যমে এই ভিডিওটি চোখে পড়েছে বাংলাদেশের অনেক মানুষের।
তারা বলছেন, সেদেশের হিন্দুদের ওপরে নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলোতে তাদের দেশের সরকার নিজের মতো করে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু সেই সব ঘটনাপ্রবাহ কেন প্রতিবেশি দেশের একটি রাজ্যের নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজীব নন্দী ভারতের রাজনীতির ওপরে নিয়মিত নজর রাখেন। তিনিও দেখেছেন ভিডিওটি।
গানটি পলিটিকাল কমিউনিকেশনের দৃষ্টি থেকে বেশ আপত্তিকর। পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের উদ্দেশ্যে প্রচারিত এই গানের ব্যাকগ্রাউন্ডে বাংলাদেশের কিছু ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করা হয়েছে খুব সচেতনভাবে। ওই সব ছবি ও ভিডিওর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের কোনও সম্পর্ক নেই। একটা উদ্দেশ্য নিয়ে খণ্ডিত তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে গানটিতে।
তার প্রশ্ন, পশ্চিমবঙ্গের নাগরিকদের জনজীবনের সমস্যার চাইতেও পড়শি দেশের ইসলাম ফোবিয়াই কি বিজেপির কাছে বেশি প্রাধান্য পেল?
মি. নন্দী বলছেন, দেখুন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক হামলাকে আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সেই হামলার খবর আরেকটি দেশের ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক দলের রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহৃত হলে সেখানে আমার আপত্তি ও উদ্বেগ তৈরি হয়।
বিজেপির ওই গানের ভিডিওটিতে ইতিহাস-চর্চা বা হিটলারের প্রচার-মন্ত্রী গোয়েবলসের প্রসঙ্গ এবং ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মতো এমন বেশ কিছু প্রসঙ্গ আছে, যেগুলি তুলে ধরা হয়েছিল কিছুদিন আগে প্রকাশিত আরেকটি গানের ভিডিওতে। মনে করা হচ্ছে ওই ভিডিওটির পাল্টা হিসাবেই বিজেপি তাদের সাম্প্রতিক ভিডিওটি তৈরি করেছে।
কৌশিক সেন বলেন, বিজেপি যে গানটা প্রকাশ করেছে, তার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা কথা বলে দিই, এটা ভীষণ খারাপভাবে নির্মিত হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন আমাদের গানটার পাল্টা একটা কিছু করতে হবে বলে তাড়াহুড়ো করে যা হোক একটা কিছু করে দিয়েছেন। এবারে যদি বিষয়বস্তুতে আসা যায়, তাহলে সেখানেও বলতে গেলে কিছুই নেই। শুধুমাত্র বাংলাদেশের কিছু ঘটনাবলী তুলে এনে মুসলিম-বিদ্বেষটাকে উসকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমার তো মনে হয় এই বিষয়টা নির্বাচন কমিশনের নজরে আনা উচিত। কারণ ভোটের মধ্যে এধরনের প্রচার তো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পক্ষে যথেষ্ট হানিকর।
বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বুদ্ধিজীবীদের প্রকাশিত গানের ভিডিওটি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন এই ধরনের বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদগুলো হয় খুব বাছাই করা। তারাই আসলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে একটা ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেন। সূত্র: বিবিসি